দ্রুত নোট প্যাড বের করে টুকে নেওয়া হয় নাম বিস্তৃত পাহাড়ির চাকমা ভাষার ভাষ্য। এনালগ ইয়াশিকা ক্যামেরায় তোলা হয় তার দু-একটি সাদাকালো ছবি। তিনি এই লেখককে জানান, তাদের গ্রামে আক্রমণ হতেই শিশুটিকে কোলে করে দুর্গম পাহাড়-জঙ্গল ভেঙে প্রায় ৩০ কিলিমিটার পথ পাড়ি দিয়ে তিনি প্রথমে পৌঁছান জেলা সদরে। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ নেতারা সার্কিট হাউজে আছেন — এই খবর শুনে তিনি আসেন সেখানে। অনর্গল চাকমা ভাষায় লোকটি শুধু একটা কথাই বলেন, বাবারা আমাকে একটু আশ্রয় দাও! চিদরেরা (সেনা বাহিনী) আমার কথা জানতে পারলে হয়তো আমাকেও মেরে ফেলবে! ... ...
আমার সাথে মিশু আপার যতবারই দেখা হয়েছে ততবারই তিনি, "হ্যালো কমরেড' বলে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করেছেন, কুশলাদি বিনিময় করেছেন। বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে পরস্পরকে অনেকে কমরেড বলে সম্বোধন করেন। আমি কোন বাম রাজনৈতিক দলের সদস্য না তারপরও কেন মিশু আপা আমাকে কমরেড ডাকেন সেটা কখনও জিজ্ঞেস করিনি বা করার প্রয়োজনও বোধ করিনি। কারণ তার সম্বোধনের মধ্যে আছে উষ্ণ আন্তরিকতার প্রকাশ। বেশ কয়েকবার আমি তার বক্তৃতা শুনেছি। আমার কাছে তার বক্তৃতার ঢং ও বেশ আকর্ষণীয় লাগে। তার বেশীরভাগ বক্তৃতার সারমর্ম হয় এরকম- এই রাষ্ট্র, সরকার সবাই হল মালিক পক্ষের। তারা শ্রমিকের রক্ত চুষে আজকে গাড়ী হাঁকায়, এসির বাতাসে ঘুমায়। এই সব লুটেরাদের আমাদের চ্যালেঞ্জ করতে হবে। তাদেরকে আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলতে হবে। শ্রমিক শ্রেণীর জয় সুনিশ্চিত। ... ...
পথে ঘাটে উত্যক্তকারী বললে চর্যাপদীয় শোনায়। এক সময়ে এটাকে টন্টিং বলা হতো। মামুদের দেখতাম জিনস পরে বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে গীটার বাজাতে। আর শিস দিতে,মাউথ অর্গান বাজাতে। রাজেশ খান্নার মেরি সপনেকি রাণী তুমি আওনাকো দেখে বাপ চাচাদের প্রজন্মের চারুচর্চার লক্ষণ দেখেছি। দাদুদের অশোক কুমারো কম ছিলেন না। ... ...
মজা হলো, রবীন্দ্রনাথ যখন অসমিয়াকে বাংলা বলে ভুল করছিলেন তখন অসম বৃহৎ বাংলারই এক প্রান্তীয় অঞ্চল ছিল। আজ যখন অসমিয়া পণ্ডিতেরা ওই একই পথ ধরে সিলেটিকে অসমিয়া বলে প্রচার করে থাকেন তখন সিলেটিদের বাস্তবতা হলো তাদের এক বড় ভাগ অসমের প্রান্তীয় তিনজেলা কাছাড়-করিমগঞ্জ-হাইলাকান্দির সংখ্যালঘু বাসিন্দা। কামতাপুরিরা অসম, পশ্চিমবাংলা দুই প্রদেশেরই সংখ্যালঘু বাসিন্দা। তাই তাদের ধরে দু'পক্ষই দড়ি টানা টানির খেলা খেলে থাকেন। বাংলাদেশেও রয়েছেন তারা, কিন্তু সংখ্যাতে এতো অল্প যে ওদের কথা কেউ ভুলেও মুখে আনেন না। সেখানে চাকমা হাজংদের কবে বাঙালি বলে মানানো যাবে তার জন্যে কিছু বাংলাভাষাপ্রেমীদের রাতের ঘুম হয় না ভালো করে। সম্ভবত ২১ ফেব্রুয়ারীর সকালে শহীদ বেদির তলায় গিয়েও তারা তাদের প্রার্থনা জানাতে ভুল করেন না। যে দেশের উদ্যোগে ২১এর দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পায় সে দেশে এখনো বাংলার বাইরে কোনো ভাষার রাষ্ট্রীয় কোনো স্বীকৃতি নেই এর চে' লজ্জার কথা আর কী-ই বা হতে পারে! অথচ এক দুটি নয় সে দেশে প্রায় পয়তাল্লিশটি ছোট বড় অবাঙালি নৃগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত পঁচিশটিরও বেশি ভাষা রয়েছে। ... ...
তবে আপনি এইসব মহান উক্তি যখন করছেন, তখন ইউকিলিকস র্যাব (র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ান নয়, পড়ুন, রক্ষী বাহিনী এগেইন ব্যাক) নিয়ে আপনাদের গর্বের বেলুনটি লিক করে দিয়েছে। বেয়াড়া ইউকিলিকসকে উদ্ধৃত করে দি। গার্ডিয়ান জানাচ্ছে, গণতন্ত্রের মহাপ্রভু ব্রিটিশ সরকার স্বয়ং নাকি খুনি এই সরকারি বাহিনীটিকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে! আর প্রতিষ্ঠার পরে গত ছয় বছরে ড়্যাবের বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে নাকি মারা গেছে হাজার খানেক লোক। ইতিহাস সাক্ষী, পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সিরাজ সিকদারকে বন্দী অবস্থায় গুলি করে হত্যার পর তখনকার প্রধানমন্ত্রী ও আপনাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ('বঙ্গবন্ধু' বলবো কী?) সংসদে দম্ভ করে বলেছিলেন, কোথায় আজ সিরাজ সিকদার? এরও আগে তিনি কমিউনিস্ট ভূতের আতংকে হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, নকশাল দেখা মাত্র গুলি করা হবে! মাননীয় মন্ত্রী, সে দিনও আপনারা ভুলে গিয়েছিলেন, নকশাল কারো গায়ে লেখা থাকে না। ... ...
দীর্ঘদিন পাহাড়ে, বনে-বাদাড়ে, আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলগুলো ঘুরে জেনেছি, এ দেশে সাধারণভাবে শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে থাকা হত-দরিদ্র প্রধান প্রধান আদিবাসী গোষ্ঠিগুলোর (চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, রাখাইন, মনিপুরী, গারো, সাঁওতাল ও খাসিয়া) প্রত্যেকেই নিজেস্ব ভাষা ও নিজ ভাষার বর্ণলিপি অনেক সমৃদ্ধ। আবার কয়েকটি আদিবাসী গোষ্ঠির নিজেস্ব বর্ণমালা না থাকলেও তাদের রয়েছে রোমান বর্ণমালায় ভাষা চর্চার ঐতিহ্য। কিন্তু চর্চার অভাবে এ সব বর্ণমালার সবই এখন বিলুপ্ত প্রায়। এরফলে নতুন প্রজন্মের আদিবাসীরা নিজ ভাষায় কথা বলতে পারলেও নিজেস্ব ভাষায় তারা একেবারে প্রায় অজ্ঞ। অথচ মাত্র চার দশক আগেও পরিস্থিতি এতোটা বিপন্ন ছিলো না। তখন নিজ মাতৃভাষা লিখিত চর্চার পাশাপাশি নিজস্ব উদ্যোগে শিশুশিক্ষায় ভাষাটির বর্ণপরচিয়ও চলতো। চাকমা রাজা ব্যরিস্টার দেবাশীষ রায় আলাপকালে বলেন, অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, সারাদেশের শিশু শিক্ষার ক্ষেত্রে আদিবাসী শিশুর ঝরে পড়ার হার অনেক বেশী। এর একটি কারণ- ভাষাগত বাধা। আদিবাসী শিশু বাসায় যে ভাষায় কথা বলছে, স্কুলে সে ভাষায় লেখাপড়া করছে না। বাংলা বুঝতে না পারার কারণে শিশুমনে পাঠ্যবই কোনো দাগ কাটছে না, স্কুলের পাঠ গ্রহণ করাও তার জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। ... ...
২৪ অক্টোবর। লং মার্চের প্রথম দিন। সকাল ৭ টায় মেহেদীর ফোন আসে। 'সব ঠিক আছে তো ?' ফোন ধরতে ধরতে মনে মনে ভাবি আমি। 'উঠসো ঘুম থেকে? রাস্তায় কিন্তু ভয়াবহ জ্যাম। শিগগির বুড়োর (আনু মুহাম্মদের) বাসার দিকে রওনা দাও। তা না হলে দেরী হয়ে যাবে।' মেহেদীর উৎফুল্ল গলা পাই ফোনের অপর প্রান্তে। এরই মধ্যে সে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে। ... ...
রিজওয়ানা শমশাদ মনে করেন ১৯৮০র সূচনালগ্নে ভারতীয় জনতা পার্টিসৃষ্ট উন্মাদনা আর পরে ১৯৯০তে লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশী মুসলমানের অনুপ্রবেশ আসলে জাতীয় অর্থনীতির উপরে একটা খাঁড়ার ঘা বিশেষ যা ভারতের অভ্যন্তরীন সাম্যবাদ এবং সুরক্ষার বিপক্ষে একটা বড় প্রশ্নচিহ্ন। এই ঘটনার প্রত্যক্ষ সংযোগ ভারতের একাধিপত্য এবং সার্বিক চেতনার পরিপন্থী। অপরপক্ষে জনভিত্তিক এই অভিবাসনের প্রত্যক্ষ ফল হতে পারে বাংলাদেশী নাগরিকদের ভারতের একটি রাজ্য থেকে পৃথক রাজ্যের দাবি করা। ১৯৯৫ সালে সেন্টার ফর স্টাডি অফ সোসাইটি অ্যান্ড সেকুলারিজ্মএর দ্বারা করা একটি পর্যবেক্ষণ অনুসারে, বিজেপি এবং শিবসেনার অভিযোগ শুধু অত্যুক্তি বা অতিশয়োক্তি নয়, চূড়ান্ত মিথ্যাচারও। ভয় আর অসুরক্ষার বোধে জন্ম নেয় হিন্দুত্বের' পরাকাষ্ঠা। অভিবাসীরা তখন তাদের রোজি-রুটির চক্করে শিখে নিচ্ছে সচ্ছ্বল বেঁচে থাকা। বিজেপি-শিবসেনা জোট দাবী করেছিল যে শুধু মুম্বইতে তিন লক্ষ অবৈধ বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী। ১৯৯৮ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন সময়ে তারা শনাক্ত করে ফেরত পাঠিয়েছিল মাত্র দশ হাজার অবৈধ কর্মচারিদের। ... ...
অবশেষে রাত যখন কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে গভীরভাবে জেকে ধরল খামারকে, আর আচমকা হিম বাতাস কাঁপিয়ে দিতে থাকল শরীর, তখন সবাই ঘন হয়ে বসেছিলাম অগ্নিকুন্ডের চারপাশে। হয়তবা গভীর রাতের প্রকৃতি আর কুয়াশার চাদর ঘুমের কোলে ঢলে পড়া মানুষগুলোর প্রাণে বাজতে থাকা আনন্দধ্বনি কিছুটা হলেও থিতিয়ে এনেছিল, কিন্তু আগুনের লেলিহান শিখার চারপাশে মেলে ধরা হাতগুলো বেয়ে শরীরের দিকে অগ্রসরমান উষ্ণতা কেনজানি থিতিয়ে আসা সেই উত্তেজনাকেই পুনরোজ্জীবিত করছিল বারবার আর কয়েকদিন ধরে ক্রমশ: জমতে থাকা দারুণ স্মৃতিগুলো নিজেদের অজান্তেই থরে থরে সাজিয়ে পড়ছিল প্রাণের গভীরে। কেউ কেউ কিছুক্ষণ পরপরই উসকে দিচ্ছিল আগুন আর আমি গনগনে শিখার দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, এমন প্রকৃত অবকাশই শিল্পীদের একান্ত প্রয়োজন, যেখানে সে খুব ভালভাবেই তার বোধের গভীরে প্রবেশ করে অনুধাবণ করতে পারে শিল্প, প্রকৃতি আর শব্দের ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা নৈ:শব্দের বিপুল কলরোলের অদৃশ্য যোগসূত্র, যা তাকে হয়ত আরও বেশ কিছুদিন রশদ যোগাবে সামনে এগিয়ে যাবার। ... ...
এরপরে তারা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে এবং প্রায় সারারাত জিজ্ঞাসাবাদ করে। এই জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাদের জিজ্ঞাসা ছিল প্রধানত বিভিন্ন আন্দোলনে আমি ঘরের খেয়ে বনের মোষ কেন তাড়াচ্ছি, আমি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র না হয়েও কেন তাদের আন্দোলনে যোগ দিয়ে নিজের জীবন হুমকির মুখে ফেলেছি, এই রাষ্ট্রবিরোধী কাজের জন্য আমি অর্থনৈতিক ভাবে কীভাবে লাভবান হয়েছি, এত বড় এবং লম্বা লেখা আমি কোন ধরণের আর্থিক সুবিধা ছাড়া কেন লিখলাম সেটা, আমি নাস্তিক কিনা, আমি শুকর খাই কিনা, নামাজ রোজা কেন করি না, ধর্মবিরোধী লেখা কেন লিখি, ইত্যাদি। ... ...
সেদিন কল্পনার মা বাঁধুনী চাকমার দেখা মেলেনি। তবে আরো কিছুদিন পরে বৃদ্ধা মা চোখ মুছতে মুছতে বলেছিলেন, তার একমাত্র মেয়ে অপহরণের পর এই অপহরণকে নিয়ে হেলিকপ্টার-রাজনীতির কথা। তিনি বলেছিলেন, ঢাকা থেকে সেনা হেলিকপ্টারে করে কিভাবে কথিত মানবাধিকার সংস্থার নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সর্ম্পক বিভাগের অধ্যাপক, জানিপপ নামে একটি এনজিও প্রধান) সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাদের গ্রামে আসেন। তারা তাকে বার বার চাপ দিচ্ছিলেন, কল্পনা চাকমাকে শান্তিবাহিনী অপহরণ করেছে, কিন্তু এখন শান্তিবাহিনীই এই অপহরণের দায় চাপিয়ে দিচ্ছে সেনা বাহিনীর ওপর - এমন একটি স্বীকারোক্তি দেওয়ার জন্য। কিন্তু নিজের মেয়েকে নিয়ে এমন মিথ্যে রাজনৈতিক প্রচারে তিনি কিছুতেই রাজী হননি। এ নিয়ে তাকে নানা হুমকি-ধামকি দেওয়া হচ্ছে। ... ... ...
বাংলা উইকিপিডিয়ার প্রধান উদ্যোক্তা এবং আমেরিকার জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের কম্পিউটার বিজ্ঞানী ড| রাগিব হাসান। এক ইমেইল বার্তায় তিনি এই লেখককে বলছেন, গত চার দশকে বাংলা ভাষার ব্যবহার এগিয়ে গিয়েছে অনেকটা। এ ক্ষেত্রে ইউনিকোড প্রযুক্তি সবচেয়ে বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। এতদিন কম্পিউটারে বাংলা লেখার জন্য বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হতো, যার কোনোটির সঙ্গে কোনোটির মিল ছিল না। গত পাঁচ বছর ধরে সার্বজনীন ইউনিকোডে বাংলা লেখা হচ্ছে, ফলে ইন্টারনেটে বাংলার ব্যবহার অনেক বেড়ে গেছে। বাংলা ব্লগের বিপুল জনপ্রিয়তা ও বাংলা উইকিপিডিয়ার বিস্তার লাভই এর বড় প্রমাণ। "অভ্র' সফটওয়্যার উদ্ভাবন করেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান খান। মেহেদী, রিফাতুন্নবি, তানভিন ইসলাম সিয়াম, রাইয়ান কামাল, শাবাব মুস্তফা, নিপুণ হক -- এই কয়েকজন বন্ধু গত ছয় বছর ধরে অভ্র নিয়ে কাজ করছেন। ... ...
আমাকে রক্ষা করতে আমার মা জননী একদিন দক্ষিণ দেশে চলে এল। রীতিমত উন্মাদ দশা। আমাকে যে বাঘে খায় নি, কুমোইরে খায় নি, বা ডাইনীতে কাঁচা গেলে নি দেখে তার ধড়ে প্রাণ ফিরে এল। রক্ষাকালীর উদ্দেশ্যে পাঁচসিকে মানত করে বসল। বলল, বাবা, তোর এখানে থাইকা কাম নাই। বাড়ি ফিরে চল। ছেলেকে নিয়ে ঘরে দোর দিয়ে বসে আছে স্নেহময়ী মা। জানালাও আটকেছে শক্ত করে। চোখে ঘুম নাই। দরোজায় শব্দ হল। মার মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল। খুলতে গেলে হাত চেপে ধরেছে। বলছে, খুলিস না। খুলিস না। ডাকাইত। ডাকাইত আইছে। ডাকাইত না। প্রতিবেশী বৌদি এসেছেন। হাতে পাকা আমের ঝুড়ি। খেয়ে মা বলল, অ মা, এ দেহি আম--মিঠা। ... ...
ঐ যে স্কুলপড়ুয়া আমার যে বড় ভাই ছিলেন, চাচাতো ভাই---তাদের মনে হয় পাঠ্য ছিলো একটা বই---সে বইটা গল্পগুচ্ছ। কিন্তু আমার স্মৃতিতে এতটা স্পষ্ট নেই যে পুরো গল্পগুচ্ছের সব গল্পই---প্রথম খণ্ডে অন্তত---সব গল্প থাকার তো প্রশ্নই ওঠে না---তিন খণ্ডে তো পরবর্তীকালে গল্পগুচ্ছ বেরিয়েছে। প্রথম খণ্ডেরও সব কটি গল্প ছিলো কিনা তাতেও আমার সন্দেহ। আমার মনে হয়, প্রথম খণ্ড থেকে কিছু গল্প---সাত-আটটা গল্প হতে পারে আরকি--- আলাদা করে নিয়ে র্যাপিড -রিডার ধরণের কিছু একটা করা হয়েছিলো। রবীন্দ্রনাথেরই গল্পগুচ্ছ---তার মধ্যে যে গল্পগুলো ছিলো স্পষ্ট মনে আছে আমার। এবং যতদূর মনে হয় প্রথম খণ্ডের দুটো তিনটে গল্প সেখানে ছিলো না। সে জন্যই বলছি, গল্পগুচ্ছেরও ভেতর থেকে বাছাই করা কিছু গল্প। দ্রুতপঠনের জন্যে এ বইটা তৈরি করা হয়েছিলো। এই বইটা, যত্রতত্র যেখানে সেখানে পড়ে থাকতো। আমার ঐ ভাইয়ের পড়াশোনায় তো তেমন মন ছিলো না। বইপত্র কোথায় কী থাকত সেটার খবর রাখতেন না। এই গল্পগুচ্ছের প্রথম মলাটটা নেই। মলাটটা উঠে চলে গেছে, শুধু গল্পগুচ্ছ লেখা আছে---এটুকু মনে আছে। আর যত্রতত্র পড়ে থাকতো এটাও মনে আছে। কখনো হয়তো ঢেঁকির কাছে আছে, ঢেঁকিটা আছে উঠোনে। আঙিনার একপাশে ঢেঁকি, সেই ঢেঁকিটার ওপরে। কখনোবা ঢেঁকিটার পাশে। কখনো মাটির খুব চওড়া বিস্তৃত যে তাওয়া, সেই তাওয়ার কোনো একটা জায়গায়। ... ...
নেপথ্যে মুখস্থবিদ্যার একটা মহিমা আছে সন্দেহ নেই। কিন্তু যখন একপাক্ষিক গায়ন নয়, সতত জারি করাই আছে যুদ্ধ, তখন তো আর কেবল মুখস্থ জ্ঞান ঝাড়লে হয় না। প্রতি মুহূর্তে নতুন করে পদ বাঁধতে হচ্ছে, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করবার জন্য পদবন্ধাকারেই আরেকটা প্রশ্ন ছুড়তে হচ্ছে। এই সহজাত কবিত্বে তাঁদের প্রতি যারপরনাই শ্রদ্ধাবিনত হতে হলো। মনে হলো, এ ক্ষমতা অপরিসীম। বাক্যে-বাক্যে, কখনো তা সম্ভব না হলে অবশ্যই পরের বাক্যের সাথে একটা বলপ্রয়োগহীন অন্ত:মিল থাকছেই। সবচেয়ে প্রণিধানযোগ্য হলো এর স্ফূর্তিটা। পরে জেনেছি এসব কবিতার সবই তাঁরা তৎক্ষণাৎ বানান না, এর কিছু কিছু আগেই তৈরি করা, সময়মতো যা উপস্থাপন করেন মাত্র। তবে উপস্থাপিত সব পদই যে তা নয়, সেটা বোঝা যায় তাৎক্ষণিকভাবে উত্থাপিত প্রশ্নের সাথে সংগতি স্থাপনের উপযোগিতা দেখে। এসবে যথেষ্টই পারঙ্গম মনে হলো তাঁদের, যে স্ফূর্তি নবীন কবিতাকর্মী আমার তখনো নেই (এখনো কি আর আছে!)। ... ...
সামনের অন্ধকার ভবিষ্যতের আশংকায় দিশেহারা রিকশা শ্রমিকরা উপায়ন্তর না দেখে অবশেষে শুরু করেন ভাঙচুর। সেই ভাঙচুরে স্বাভাবিক ভাবেই গাড়িওয়ালা উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে অফিসগামী পথচারী মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত ভোগান্তির মধ্যে পড়েন। সেই ভোগান্তির চিত্র, খবর পত্রিকার পাতায় বিশদ ভাবে স্থান পেলেও যে নির্মম বাস্তবতায় রিকশা শ্রমিকেরা এই ""তান্ডব'' চালাতে বাধ্য হয়েছেন তা কিন্তু তথাকথিত গণমাধ্যমে স্থান পায়নি। তাই বাস-গাড়ি থেকে তাড়াহুড়া করে নামতে গিয়ে পথচারী আহত হওয়ার খবর ছাপা হলেও, কিংবা গাড়ি-যাত্রী শিশুর কান্নার ছবি ছাপা হলেও রিকশা চালকের অন্ধকার ভবিষ্যতের কথা, বস্তির জীর্ণ ঘরে অপুষ্ট শিশুটির শুকনো মুখের ছবি আমরা পত্রিকার পাতায় দেখিনা। এগুলো গণমাধ্যম না শ্রেণীমাধ্যম? ... ...
খেলা শেষে সেই আশাবাদী মানুষটার কাছে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলাম। ভদ্রলোক নির্বিকার মুখে বলল, "ব্যাপার না এটা। বিশ্বকাপের সব গেম কি আমরা একলাই জিতব নাকি? সব দলই তো দুই তিনটা ম্যাচ জিতবে, দুই তিনটা হারবে।' ভেবে দেখলাম কথাটি সত্যি। আজ হেরেছি, কাল জিতব। সেই জেতার দিনের খেলা দেখতে আসার আশা নিয়ে আজ তাই গ্যালারি ছাড়লাম। ... ...
স্থানীয়, জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক স্তরে ড: ইউনুসের সমালোচক বা সমর্থক উভয় দলই সংখ্যায় বেশ ভারী। ৫ মার্চ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এজেন্সি, মানবাধিকার সংগঠন, মার্কিন স্বরাষ্ট্র দপ্তর ও অন্যান্যদের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের পাঠানো একটি ইমেইলে হাসিনা তনয় সজীব ওয়াজেদ লিখছেন যে বাংলাদেশে ইউনুসের একমাত্র পরিচিতি নোবেল পুরষ্কার প্রাপক হিসেবে। রাজনৈতিক ভাবে তাঁর কোনও অস্তিত্ব নেই। গ্রামীণ ব্যাঙ্কের বিরুদ্ধে বিশাল আর্থিক দুর্নীতি, কর ফাঁকি ও তহবিল তছরুপের অভিযোগ এনে সজীব জানাচ্ছেন এর প্রত্যেকটিই ফৌজদারি অপরাধ হওয়া সত্বেও বাংলাদেশ সরকার ইউনুসের বিরুদ্ধে কোনওরকম শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত থেকেছেন। সরকারের একমাত্র লক্ষ্য হল ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতাদের আরও শোষনের হাত থেকে বাঁচানো। ... ...
শর্মিলা বোসের "সিভিল ওয়ার' তত্ত্বের ভুল হলো তা পাকিস্তানকে একটি জাতিরাষ্ট্র ভেবেছে এবং মুসলমানিত্বকে সেই জাতিরাষ্ট্রের ঐক্যসূত্র ধরে নিয়েছে। যে পাকিস্তান মুসলমানদের একজাতি বলেছে, সে নিজেই আবার বাঙালি মুসলমানদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালিয়েপ্রমাণ করেছে, তারা এক জাতি নয়। ব্রিটিশ ভারতে মুসলিম ঐক্যটা কংগ্রেসি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সাময়িক রাজনৈতিক কৌশল ছিল, এবং রাজনৈতিক কারণেই হিন্দু জমিদার শ্রেণীর ভীতি অপসারিত হওয়ায় ঐক্যটাও প্রয়োজন হারিয়েছে এবং পাকিস্তান ভেঙ্গে গেছে। একে দেশভাগ বলে না, বলে ভাঙ্গন এবং তা রাষ্ট্রের ভাঙ্গন। এর মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্র পেয়েছে তার আসল রূপ। যে রূপটা বণিক-সামরিক পাঞ্জাবি এলিটতন্ত্রের, যা ব্রিটিশ-মার্কিনের ঔপনিবেশিক জের বহন করছে, ঔপনিবেশিক ব্রিটেন আর সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার উত্তরাধিকার ও রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে কাজ করছে। আর বাংলাদেশের আবির্ভাব এই জোটেরই বিরুদ্ধে। যে কোনো রকম উপনিবেশিকতা ও আঞ্চলিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে ভাষাভিত্তিক, সেক্যুলার, কৃষকমেজাজি জাতিরাষ্ট্র হিসেবে। এটাই নিশ্চয় এই রাষ্ট্রের মকসুদে মঞ্জিল নয়, তবে সেটা অন্য আলোচনা। এখন কেবল এই সত্যটা আমাদের মনে থাকা চাই দ্বিজাতিত্ত্বের মিছা আশা এবং ভারতবর্ষীয় একজাতিতত্ত্বের মায়ার নাগপাশের বাইরে এর আবির্ভাব হয়েছিল। আর মান্য করা চাই যে, এই রাষ্ট্রের ভিত নির্মিত হয়েছে সংগ্রামে, রক্তে, অশ্রুতে আর আগুনে। যার সম্মান ও সার্থকতা আজ অবধি আমরা দিতে পারি নাই। সংশোধনবাদী ইতিহাস চর্চা এরই সুযোগ নিচ্ছে এবং নিতে থাকবে। ... ...
সমাবেশস্থলে পৌঁছে প্রথমেই আমার নজরে পড়ল পথসভায় যোগদানকারীদের পায়ের কাছে পড়ে থাকা হলুদ রঙের গাঁদা ফুলের পাপড়ির ওপর। বুঝলাম জাতীয় কমিটির স্থানীয় কর্মীরা ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে লং মার্চের যাত্রীদের স্বাগত জানিয়েছেন। খেয়াল করে দেখি শাড়ী পরা, পরিপাটি করে চুল বাঁধা, আর কপালে মেরুন রঙের টিপ পরা একজন তরুণী তখনও একটি ডালা থেকে ফুলের পাপড়ি ছিটাচ্ছেন। ফুল দিয়ে অতিথিদের বরণ করে নেওয়ার রেওয়াজটি এর আগে আমি বিয়ে আর গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে দেখেছি। এ ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ এটিই আমার প্রথম। তাই এক্ষেত্রেও রেওয়াজটি সাধারণ কি না তা নিয়ে আমার মনে সন্দেহ দেখা দিল। তবে স্কুলে থাকতে টেলিভিশনে দেখতাম, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের সামরিক শাসক হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদকে গলায় ফুলের মালা দিয়ে বরণ করা হত। সে এতো মালা পেত যে তাতে তার মুখ ঢাকা পড়ে যেত। ... ...